বিজয় এক্সপ্রেসের ৯টি বগি লাইনচ্যুত: মন্ত্রীর দাবি নাশকতা, রেল বলছে তদন্তে জানা যাবে

Passenger Voice    |    ১২:৪৬ পিএম, ২০২৪-০৩-১৯


বিজয় এক্সপ্রেসের ৯টি বগি লাইনচ্যুত: মন্ত্রীর দাবি নাশকতা, রেল বলছে তদন্তে জানা যাবে

রেলপথমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম দাবি করেছেন, গত রোববার কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে নাশকতায় আন্তঃনগর ট্রেন বিজয় এক্সপ্রেসের ৯টি বগি লাইনচ্যুত হয়। টাকার বিনিময়ে এক ব্যক্তি রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলে। ওই ব্যক্তি ধাওয়া খেয়ে ব্যাগ ফেলে পালিয়ে যায়। ব্যাগে তার পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে। বিএনপি ও জামায়াত এ জাতীয় কাজ করে।

তবে ঘটনার দিনের মতো গতকাল সোমবারও রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, কী কারণে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়েছে, তা তদন্তে জানা যাবে। রাজধানীর রেল ভবনে রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে একজনের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কী ঘটেছে, তা তদন্ত না করে বলা যাবে না।

তবে গতকাল রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলায় স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সুধী সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে রেলমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা জানেন কারা ট্রেনে আগুন দেয়, রেললাইনকে ধ্বংস করে। বিএনপির কাজই ষড়যন্ত্র করা। 

মাস্টার দাবি করেছিলেন, গরমের কারণে রেললাইন বেঁকে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়। পরে এই বক্তব্য থেকে সরে আসে রেলওয়ে। যদিও ট্রেনটিতে থাকা কর্মীদের সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, নাঙ্গলকোট উপজেলার হাসানপুর স্টেশনের দুই কিলোমিটার আগে একটি রেল সেতুতে লাইন বাঁকা ছিল। গরম নয়, রেললাইনের স্লিপারের ক্রুটি বা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নাটবোল্ট ঢিলা থাকায় লাইন বেঁকে যেতে পারে। সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনে কয়েকবার এমন বাঁক দেখা গেছে। 

লাইনে বাঁকের বিষয়ে রেল সচিব বলেছেন, এটা এখনও বলা যাচ্ছে না। আমাদের টেকনিক্যাল কমিটি কাজ করছে। দুর্ঘটনার ফলে বগিগুলো বাজেভাবে একটি লাইন থেকে আরেক লাইনের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। বর্তমানে একটা লাইন চালু করা হয়েছে। অন্য লাইনে নতুন স্লিপার বসাতে হবে। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করতে অন্তত তিন দিন সময় লাগবে।

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট এলাকায় বিজয় এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হওয়ায় সারাদেশের রেল যোগাযোগে শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। একটি লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল করছে। কুমিল্লার লাকসাম-চিনকি আস্তানা সেকশনে ব্রিটিশ আমলের রেললাইনের সমান্তরালে নির্মাণ করা ৬১ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইন ২০১৫ সালের ১৮ এপ্রিল চালু হয়। ১ হাজার ৮১৯ কোটি টাকায় নির্মিত এ রেলপথের মাধ্যমে সেকশনটি উন্নীত হয় ডাবল লাইনে। মাত্র ৯ বছ‌রের প‌ুরোনো এ লাইনে রোববার দুর্ঘটনা ঘ‌টে। ঘটনার ১৮ ঘণ্টার পর গতকাল সকালে ছড়ানো একটি ভিডিওতে দেখা যায়, দুর্ঘটনাস্থলে একটি ব্যাগ পড়ে রয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, ব্যাগটি রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলা ব্যক্তির। ওই ভিডিওতে এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, তিনি একজনকে ফিশপ্লেট খুলতে দেখেছেন।

তবে বিজয় এক্সপ্রেসের রেলকর্মীর সূত্র জানিয়েছে, সেতু‌তে রেললাইনে বাঁকা হওয়ার খবর আগে থেকে জানা ছিল না লোকোমাস্টারের (চালক)। ওই সম‌য়ে ট্রেনের গতি ছিল ঘণ্টায় ৭০ কি‌লো‌মিটার। বাঁক দে‌খে চালক গ‌তি কমান। তখন ইঞ্জিন ও বগির সংযোগ বাফার (কাফ‌লিং) ভেঙে যায়, ইঞ্জিনের হোসপাইপ খুলে যায়। এতে ইঞ্জিন থে‌মে যায়। তখন পেছন থেকে বগি এসে ধাক্কা দেয়। এতে বগিগুলো ছিটকে পড়ে লাইনচ্যুত হয়। 

জানা যায়, ১৫ ঘণ্টা ভোগান্তির পর গতকাল ভোর ৫টার দিকে চট্টগ্রাম-ঢাকা রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। চট্টগ্রাম-সিলেট এবং চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ-জামালপুর রেলপথেও ট্রেন চলছে। রোববারের দুর্ঘটনায় প্রাণহানি না হলেও বগি ও লাইনের বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দুর্ঘটনার ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের অন্তত ১০টি স্থানে বিভিন্ন স্টেশনে এবং পথে আটকে পড়া ট্রেনের যাত্রীদের রাতভর অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। লন্ডভন্ড হয় ট্রেনের শিডিউল। ডাউন লাইন চালু হলেও ক্ষতিগ্রস্ত আপ লাইনটি মেরামতের পর আগামীকাল বুধবার নাগাদ চালু করা হতে পারে বলে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। 

দুর্ঘটনার ফলে লালমাই স্টেশনে কর্ণফুলী, লাকসামে পাহাড়িকা, সাগরিকা, কুমিল্লায় চট্টলা, শশীদলে নাসিরাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেন আটকা পড়ে। এ ছাড়া আপ-ডাউন লাইনে চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম থেকে সাগরিকা এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়। এতে হাজারো নারী, পুরুষ, শিশু স্টেশনে ও ট্রেনে রাত কাটান। 

ঘটনা তদন্তে গতকাল রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনিছুর রহমানসহ কমিটির কর্মকর্তারা দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। নাঙ্গলকোট স্টেশন মাস্টার জামাল উদ্দিন জানান, দুর্ঘটনাকবলিত বগি সরানো হয়েছে। 

সরেজমিন দেখা গেছে, আপ লাইনের কিছু অংশে রেললাইনের অস্তিত্ব নেই। এলাকাবাসী বলছেন, নিম্নমানের স্লিপার এবং নাটবোল্ট ঠিক না থাকায় ত্রুটি ছিল লাইনে। এ কারণে একই এলাকায় গত বছরও দুর্ঘটনা ঘটেছিল।  

নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন জানান, বিজয় এক্সপ্রেসের ছিটকে পড়া বগির আঘাতে রেললাইনের পাশের দুটি বসতবাড়ি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘর মেরামতে ঢেউটিন ও নগদ অর্থ সহায়তা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে।


প্যা/ভ/ম